শিশু ফাইয়াজকে রিমান্ড দেয়ায় চাপের মুখে!
কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থী ফাইয়াজকে গ্রেফতার ও
৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড়।পাশাপাশি জাতিসংঘের শিশু অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে চাপে পড়তে পারে সংশ্লিষ্টরা।
আইনজ্ঞদের মতে,
ফাইয়াজ নামের এই শিশু ছেলেকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে কীভাবে আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে, তার আইনি ব্যাখ্যা এখানে উপস্থাপন করবো সহজসরল ভাষায়, যাতে সবার কাছেই বোধগম্য হয়।
১. আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন না, শিশু আইন-২০১৩ নামে একটা আইন আছে এবং এই বিশেষ আইনটার প্রয়োগবিধি বিদ্যমান অন্যসব আইনের ওপর প্রাধান্য পায়।
শিশু আইনের ৩ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে—
“আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে।”
মানে কোন অফেন্সের বিচার বা গ্রেফতার বা আটক সংক্রান্ত ইস্যুতে অন্য সকল আইনে যাই বলা থাক না কেন, অভিযুক্ত যদি কোন শিশু হয়, তাহলে শিশু আইন অনুযায়ীই করতে হবে সবকিছু, অন্য কোন আইন বলবৎযোগ্য হইবে না।
২. প্রশ্ন হলো— আইন অনুযায়ী ফাইয়াজ কি ‘শিশু’ ছিলো?
উত্তর হল— অবশ্যই সে শিশু। তার জন্মসনদ এবং একাডেমিক সার্টিফিকেট আদালতে উপস্থাপন করেছিলো তার আইনজীবী, সেই অনুযায়ী তার বয়স ১৭ বছর ৩ মাস। ফাইয়াজ এই ২০২৪ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে মাত্রই ভর্তি হয়েছে, তার ক্লাসও শুরু হয় নাই।
শিশু আইনের ৪ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলেই শিশু। অতএব, ফাইয়াজের ওপর শিশু আইনের বাইরে অন্য কোন প্রসিডিং চলতে পারে না।
৩. তার বিচার করা হয়েছে অন্য সবার মত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। অথচ শিশু আইন অনুযায়ী ‘শিশু আদালত’ ব্যতীত অন্য কোন আদালতের এই বিচার করার কোন এখতিয়ারই নাই, কোন অবস্থাতেই। মানে তার এই বিচারের পুরো প্রক্রিয়াটাই হয়েছে বিয়ন্ড লিগ্যাল প্রসেস।
৪. সংযুক্ত ছবি লক্ষ্য করুন। তার হাতে হাতকড়া পড়ানো, রশি দিয়েও হাত-মাজা পেঁচিয়ে বাঁধা, যেন কতবড় মহা-অপরাধী এই ছেলেটা!
অথচ শিশু আইনের ৪৪(৩) ধারা অনুযায়ী, গ্রেফতার করার পর শিশুকে কোন অবস্থাতেই হাতকড়া বা মাজায় দড়ি বা রশি পরাতে পারবে না পুলিশ।
৫. গুরুতর আরও একটা অভিযোগ আছে ফাইয়াজের পরিবারের পক্ষ থেকে। গ্রেফতার করার পর ৪ দিন ফাইয়াজের কোন খোঁজ তাদেরকে জানানো হয়নাই। চারদিন পর তাকে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ, তবুও পরিবারের লোকদেরকে ইনফর্ম করা হয় নাই। পরিবারের লোকজন এই চারদিনের প্রতিটা দিন কোর্ট চত্বরে খোঁজ করেছে তার। অবশেষে চতুর্থ দিনে গিয়ে কাকতালীয়ভাবে পেয়ে গেছে তাকে। এটা আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। তাকে আটকের সাথেসাথেই পরিবারে লোককে জানানোর অবধারিত আইন ছিলো। এমনকি শিশু আইনের অধীনে আদালতে বিচার হতে হলেও অভিভাবককে সাথে রাখাটা আইনি বিধান। কিন্তু পুলিশ পুরো কাজটাই করেছে পরিবারকে না জানিয়ে। চারদিন পর্যন্ত তার কোন খোঁজই ছিলো না। আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন এটা।
৬. আদালত কি কোন শিশুকে রিমান্ড দিতে পারে?
উত্তর হল— পারে না। শিশুকে রিমান্ডে পাঠানোর কোন বিধানই নাই আইনে।
৭. শিশু ফাইয়াজের কি জামিন প্রাপ্য ছিলো?
অবশ্যই। শিশু আইনের ৫২ ধারায় জামিনের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।
শিশু আইন একটা বিশেষ আইন। এই আইন অনুসারে পুলিশ নিজেই শিশুকে জামিন দিয়ে দিতে পারতো কোর্টে সোপর্দ করার আগেই। তার অপরাধ জামিনযোগ্য নাকি জামিন অযোগ্য সেটাও ইভেন বিবেচনা করার দরকার পড়ে না এই আইন অনুযায়ী।
তাছাড়া কোন বিশেষ কারণে পুলিশ তাকে না ছেড়ে দিয়ে যদি শিশু আদালতে প্রেরণ করে, ওইখান থেকে অবশ্যই জামিন পাওয়ার অধিকার আছে শিশুর। কোন অবস্থাতেই রিমান্ডে পাঠানোর সুযোগ নাই।
৮. আর যদি বিশেষ কোন কারণে তাৎক্ষণিক জামিন নাও দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে শিশু আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী,
শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার আদেশ দিতে পারে আদালত, এই নিরাপদ হেফাজত মানে কিন্তু সাধারণ জেল না। তাছাড়া ওই আইনেই উল্লেখ আছে এই নিরাপদ হেফাজতে রাখার বিষয়টি যদি বিবেচনা করতেও হয় (কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে) সেটা সর্বশেষ পন্থা হিসাবে বিবেচনা করিতে হইবে, যাহার মেয়াদ হইবে যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ের জন্য। এটা হলো এক্সেপশনাল ইস্যু, আর নরমাল নিয়ম হলো অপরাধ জামিনযোগ্য বা জামিন-অযোগ্য যাই হোক না কেন, তাকে জামিন দিতে হবে।
এমনকি কোন অপরাধ আদালত কর্তৃক প্রমাণ হওয়ার পর যদি শিশুকে শাস্তি দিতে হয়, তাহলে সেটা যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মত সর্ব্বোচ অপরাধও হয়, তবুও আদালত কিন্তু একজন শিশুকে নরমাল জেলে প্রেরণ করতে পারে না, আদালত বড়জোর ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’–তে প্রেরণ করতে পারে। এই আইনের ৩৪ ধারায় এসবের বিস্তারিত বিবরণ আছে।
সেখানে ফাইয়াজকে এই কোটা আন্দোলনকেন্দ্রিক মামলায় বিচারাধীন অবস্থায়( অপরাধ প্রমাণিত হয়নি কিন্তু) রেগুলার জেলে পাঠানো হয়েছে, তাও আবার ৭ দিনের রিমান্ডসহ। মানে আইনের কতবড় ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে, বুঝতে পারছেন?
আর ফাইয়াজের এই ইস্যুতে শুধু যে দেশীয় আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হয়েছে, সেটাই নয়। বাংলাদেশ কিন্তু জাতিসংঘ প্রণীত Convention on the Rights of The Child(CRC) এর স্টেইট পার্টি। ফাইয়াজের সাথে যা ঘটেছে, তা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (CRC)-এর ও চূড়ান্ত লঙ্ঘন।
আইনুজ্ঞ সাইদ আব্দুল্লাহ বিষয়টি স্পষ্ট করে তাঁর ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন!