রমজান মাস এলে আমাদের অনেকের মনে রোজার বিভিন্ন মাসআলা নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
- যেমন: রোজার নিয়ত করা কি ফরজ?
- রোজার নিয়ত না করলে কি রোজা হবে না?
- রোজার নিয়ত কিভাবে করবো?
- কখন রোজার নিয়ত করতে হবে?
- এক সাথে সবগুলো রোজার নিয়ত করা যাবে কিনা ইত্যাদি।
নিম্নে এর উত্তর কুরআন ও হাদিসের আলোকে সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরা হলো।
প্রথমতঃ সিয়াম বা রোযার নিয়ত করা ফরয। যার শাব্দিক অর্থ সংকল্প।
ধরুন কেউ মনে মনে এই নিয়াত বা সংকল্প করবে, ‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আগামী কালের রোযা রাখছি।’ এক্ষেত্রে মুখে বলা জরুরি নয়। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ”
“সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” ( সহীহ বুখারী-০১) যেহেতু রোজার নিয়ত করা ফরজ। অতএব নিয়ত না করলে রোজা হবে না।
এখন প্রশ্ন হলো রোজার নিয়ত কখন করতে হবে?
এর উত্তর হলো- ফরয রোযার নিয়ত রাতেই করা উত্তম।
কারণ আম্মাজান হাফসা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
من لم يجمع الصيام قبل الفجر فلا صيام له.
যে ব্যাক্তি ফজরের আগে রোযা রাখার নিয়ত করবে না। তার রোযা (পূর্ণাঙ্গ) হবে না। -সুনানে আবু দাউদ ১/৩৩৩; তবে রাতে নিয়ত করতে ভুলে গেলে পরের দিনে সূর্য ঢলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলেও রোযা হয়ে যাবে।
কেননা অন্য আরেকটি হাদিস থেকে এর স্বীকৃতি পাওয়া যায়। সালামা ইবনুল আকওয়া রা. বলেন, (আশুরার রোযা যখন ফরয ছিল তখন) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলাম গোত্রের একজন ব্যাক্তিকে ঘোষণা করতে বলেন,
أَنَّ مَنْ كَانَ أَكَلَ فَلْيَصُمْ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ وَمَنْ لَمْ يَكُنْ أَكَلَ فَلْيَصُمْ فَإِنَّ الْيَوْمَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ
‘যে সকাল থেকে কিছু খায়নি সে বাকি দিন রোযা রাখবে। আর যে খেয়েছে সেও বাকি দিন রোযা রাখবে। কারণ আজ আশুরা-দিবস।’-সহীহ বুখারী ২০০৭)
উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায়। কেউ যদি ফরজ রোজার নিয়ত রাতে করতে ভুলে যায়। তবে দিনের বেলা সূর্য ঢলে যাওয়ার ঘন্টা খানেক আগে নিয়ত করলে রোজা হয়ে যাবে। তবে উত্তম হলো রাতের বেলা নিয়ত করা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, সব রোজার নিয়ত কি একত্রে বা একদিনে করা যাবে?
এর উত্তর হলো- পুরো রমযানের জন্য একত্রে নিয়ত করা যথেষ্ট নয়; বরং প্রত্যেক রোযার নিয়ত আলাদা আলাদা করতে হবে।
কারণ প্রত্যেকটি রোযা ভিন্ন ভিন্ন আমল বা ইবাদত। আর প্রতিটি আমলের ক্ষেত্রে নিয়ত করা জরুরি। হাদীস শরীফে এসেছে, ” إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ”
সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।(-সহীহ বুখারী-০১) অতএব প্রতিটি রোজার পৃথক নিয়ত করতে হবে। একাধিক কিংবা রমজানের সব রোজার নিয়ত করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: রমযান মাসে নিয়ত করার পর কি রাতের বেলা সহবাস বা স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক মিলন করা যাবে?
এক্ষেত্রে মাসআলা হলো: রাতে রোযার নিয়ত করলেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত স্ত্রীর সাথে সহবাস বা মিলন করা যাবে।
এতে করে নিয়তের বা রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ
রমযানের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বা সহবাস হালাল করা হয়েছে। ( –বাকারা ২ : ১৮৭ ) এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, রমজান মাসে রোজার নিয়ত করার পর রাতের বেলা স্ত্রী সহবাস করা বৈধ।
আরো একটি প্রশ্ন জাগতে পারে। রোজার নিয়ত কখন থেকে শুরু হয় বা কখন থেকে রোজার নিয়ত করা যায়?
উত্তর- এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে রোজার নিয়তের সময় শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে।
যেমন ধরুন- মঙ্গলবারের রোযার নিয়ত সোমবার দিবাগত রাত তথা সূর্যাস্তের পর থেকে করা যায়। সোমবার সূর্যাস্তের আগে মঙ্গলবারের রোযার নিয়ত করলে নিয়ত হবে না। রোজার নিয়ত সূর্যাস্তের পরেই করতে হবে। কেননা, হাদীস শরীফে রাতে নিয়ত করার কথা বলা হয়েছে।-আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৪৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৭৭
রোজার নিয়তের সংক্ষিপ্ত বিধান:
১. নিয়ত মুখে বলা জরুরি নয়:
নিয়তের জন্য মুখে কিছু বলা ইসলামের বিধানে আবশ্যক নয়, বরং নিয়ত একটি হৃদয়ের সংকল্প। অনেক মুসলিম নিয়ত করতে দোয়া হিসেবে কিছু নির্দিষ্ট বাক্য মুখে বলে থাকেন, যেমন “নাওয়াইতু আন আসুমা গাদান”। তবে কুরআন ও হাদিসে নিয়ত মুখে বলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়নি।
২. একসাথে রোজার নিয়ত:
কিছু মুসলিম ভাই-বোন একসাথে পুরো রমজানের জন্য নিয়ত করার কথা ভাবেন, তবে হাদিসের আলোকে দেখা যায় যে, প্রতিদিন পৃথকভাবে নিয়ত করা আবশ্যক। কারণ প্রতিটি রোজা একটি আলাদা ইবাদত এবং প্রতিটি ইবাদতের জন্য নিয়ত অপরিহার্য। অন্যথায় রোজা হবে না।
অন্যান্য মাসআলা সম্পর্কে আরও ব্যাখ্যা:
১. রাতের বেলা রোজার নিয়তের পর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন:
ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত স্ত্রী সহবাস করা বৈধ। এতে রোজার নিয়তের কোনো ক্ষতি হবে না। এটি স্পষ্টভাবে সূরা আল-বাকারাহ-এর ১৮৭ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
২. সেহরির গুরুত্ব:
রোজার নিয়তের সাথে সেহরি খাওয়ার গুরুত্বও উল্লেখযোগ্য। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السُّحُورِ بَرَكَةً “সেহরি করো, কারণ সেহরিতে রয়েছে বরকত।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ১৯২৩)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, সেহরির সময়ের মধ্যে নিয়ত করাই উত্তম, কারণ এটি রোজার সুন্নাহ এবং রসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় আমল।
উপসংহার:
রোজার নিয়ত করার গুরুত্ব এবং তা না করলে রোজা হবে কি না, এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের আলোকে যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। মূলত, নিয়ত না থাকলে কোনো ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না! কারণ নিয়ত হলো ইবাদতের আত্মা। প্রতিদিনের রোজার জন্য আলাদা নিয়ত করা জরুরি এবং এটি ইসলামি শরীয়াহর শর্ত।
আল্লাহ আমাদেরকে রমজানের সকল মাসআলা মাসায়েল জেনে তার উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
FAQ – রোজার মাসআলা মাসায়েল সম্পর্কে
রোজার নিয়ত না করলে কি রোজা হবে?
উত্তর: না, ফরয রোজার জন্য নিয়ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আবশ্যক। নিয়ত ছাড়া ফরয রোজা শুদ্ধ হবে না, কারণ নিয়ত ইবাদতের মূল শর্ত। তবে, নফল রোজার ক্ষেত্রে দিনের বেলায় দুপুরের আগে নিয়ত করা যায়, যদি আপনি তখনো কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ না করে থাকেন।
রোজার নিয়ত কিভাবে করতে হয়?
উত্তর: রোজার নিয়ত মনে মনে রোজার সংকল্প বা ইচ্ছা করলেই হয়। এক্ষেত্রে মুখে উচ্চারণ করা প্রয়োজন নয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি মনে মনে এই সংকল্প করবেন, “আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আগামীকাল রোজা রাখছি।”
রোজার নিয়ত কখন করতে হয়?
উত্তর: ফরয রোজার নিয়ত রাতের মধ্যে করতে হবে, অর্থাৎ ফজরের আগেই করতে হবে। এটি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ এবং হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তবে ভুলে গেলে দিনের বেলায় সূর্য ঢলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলেও রোজা শুদ্ধ হবে।
রোজার নিয়তের পর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, রমজানের রাতে রোজার নিয়ত করার পরেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত বৈধভাবে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। এতে রোজার নিয়ত এবং ইবাদতের কোনো ক্ষতি হবে না।
একসাথে রমজানের সব রোজার জন্য নিয়ত করা যাবে কি?
উত্তর: না, পুরো রমজানের জন্য একসাথে নিয়ত করা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি দিনের রোজার জন্য আলাদা নিয়ত করতে হবে, কারণ প্রতিটি রোজা একটি পৃথক ইবাদত।
রোজার নিয়তের সময় কখন শুরু হয়?
উত্তর: রোজার নিয়তের সময় শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে এবং ফজরের আগে পর্যন্ত। সুতরাং আগামী দিনের রোজার জন্য নিয়ত করা যাবে সূর্য ডোবার পর থেকে পরবর্তী দিনের ফজরের আগ পর্যন্ত।
নফল রোজার নিয়ত কি দিনে করা যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, নফল রোজার জন্য আপনি দিনে নিয়ত করতে পারেন, যদি সূর্যোদয়ের পর থেকে কিছু না খেয়ে থাকেন। তবে, এটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং ফরয রোজার জন্য নয়।
রোজার নিয়ত কি মুখে বলতে হবে?
উত্তর: না, নিয়ত মনে মনে করলেই হবে। মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়, তবে আপনি চাইলে মুখে দোয়া হিসেবে কিছু বলতে পারেন।
সেহরির সময়ের মধ্যে রোজার নিয়ত না করলে কি হবে?
উত্তর: যদি আপনি সাহরির সময় নিয়ত করতে ভুলে যান, তবে দিনের বেলায় সূর্য ঢলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলে রোজা শুদ্ধ হবে। তবে এটি ভুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ইচ্ছাকৃত না।
রাতের বেলা রোজার নিয়তের পর সেহরি খাওয়া যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, রোজার নিয়ত করার পরেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত সাহরি খাওয়া যাবে। নিয়ত করার পর সেহরি খাওয়ায় রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।